মাদকাসক্তির কারণ ও প্রতিকার

মাদকাসক্তি শুধু একজন ব্যক্তির নয়—একটি পরিবার, সমাজ ও জাতির নীরব বিষফোঁড়া। আজকের তরুণ সমাজ, যার কাঁধে ভবিষ্যতের দায়িত্ব, তার একটি বড় অংশ এই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৫ কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকের শিকার, এবং প্রতি বছর লাখ লাখ পরিবার এই নেশার ছোবলে ভেঙে পড়ছে। বাংলাদেশেও চিত্র ভয়াবহ—সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশে প্রায় ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ মাদকাসক্ত, যাদের বড় অংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬৩% মাদক বা আসক্তিজনিত সমস্যায় জড়িত।
মাদক শুধু একটি অভ্যাস নয়—এটি একটি সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক ব্যাধি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী এমন অভ্যন্তরীণ শূন্যতা মানুষকে এই পথে নিয়ে যায়? মাদকের ছায়া থেকে কি কেউ সত্যিই মুক্তি পেতে পারে? উত্তরের খোঁজ পেতে হলে আমাদের জানতে হবে—এই আসক্তির কারণ, এর প্রতিকার, এবং সর্বোপরি, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর ভূমিকা।
এই লেখায় আমরা জানব মাদকের ভয়াল বাস্তবতা, কীভাবে এটি জীবনে প্রবেশ করে, এবং কীভাবে সঠিক পথ ও সহায়তায় একজন মানুষ আবার আলোর মুখ দেখতে পারে।
মাদকাসক্তি কি ও এটি কীভাবে কাজ করে?
মাদকাসক্তি হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে এবং তা ছাড়া স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। মাদক বলতে সাধারণত যেসব পদার্থ গ্রহণ করলে স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে, মনোজগতে পরিবর্তন আসে এবং শরীরের উপর নির্ভরতা তৈরি হয়—তা-ই বোঝানো হয়। যেমন: গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ঘুমের ওষুধ, অ্যালকোহল, ও বিভিন্ন ইনহেল্যান্টস। মাদকাসক্তি একটি মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি মাদক গ্রহণের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মাদক গ্রহণের ফলে ডোপামিন নামক ‘সুখানুভূতির’ হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সেই ভালো লাগার অনুভূতি আবার পেতে গিয়ে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে আসক্তি গড়ে ওঠে।
মাদকাসক্তির পেছনের মূল কারণগুলো কি?
মাদকাসক্তি কোনো একক কারণে ঘটে না। এটি একটি বহুমাত্রিক, জটিল ও ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা সমস্যা, যার পেছনে জৈবিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত নানা উপাদান কাজ করে। নিচে মাদকাসক্তির সম্ভাব্য প্রধান কারণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. জৈবিক ও বংশগত কারণ
মানব মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা আনন্দ ও প্রেরণার অনুভূতির সঙ্গে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ব্যক্তির মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে পর্যাপ্ত ডোপামিন নিঃসরণে অক্ষম থাকে। ফলে তারা জীবন থেকে পর্যাপ্ত সুখানুভূতি পায় না এবং সেই শূন্যতা পূরণে মাদকের আশ্রয় নেয়।
এছাড়াও, বংশগত ঝুঁকির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেসব পরিবারে পূর্বে মাদকাসক্তির ইতিহাস রয়েছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এই ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
২. মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ভূমিকা
অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক সমস্যাগুলোর সঙ্গে মাদকাসক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা, পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মাদককে সাময়িক স্বস্তির উপায় হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। এটি ব্যাক্তিকে স্বল্পমেয়াদী আরাম দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে মাদকের প্রতি নির্ভরতা আরও বাড়িয়ে তোলে এবং মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।
৩. পারিবারিক অবহেলা ও সহিংস পরিবেশ
শিশু বা কিশোর বয়সে পারিবারিক স্নেহ, নিরাপত্তা ও সংযোগের অভাব একজন মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরিবারে অবহেলা, ভাঙন, সহিংসতা, অতিরিক্ত কঠোরতা বা অনুপস্থিতি একজন তরুণের মধ্যে শূন্যতা তৈরি করে যা তারা মাদকের মাধ্যমে পূরণ করতে চেষ্টা করে। সুখী ও সংহত পরিবারের শিশুদের তুলনায় ভাঙা বা অবহেলিত পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা মাদক গ্রহণের প্রতি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
৪. সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ
বন্ধুদের প্ররোচনা (peer pressure) মাদক গ্রহণের একটি বড় কারণ, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের মধ্যে। অনেক সময় মাদক গ্রহণকে “বড়দের মতো আচরণ” বা “কুল” হিসেবে দেখা হয়। তাছাড়া, হতাশাজনক সামাজিক অবস্থা, বেকারত্ব, দরিদ্রতা, বা অতিরিক্ত অবসর সময়ও মানুষকে নেশার দিকে ঠেলে দিতে পারে। নিম্ন আয়ের এলাকায় মাদক সহজলভ্য হওয়ায় সেইসব অঞ্চলের যুবসমাজ অধিক ঝুঁকিতে থাকে।
৫. কৌতূহল ও আনন্দ লাভের ইচ্ছা
প্রথমবার মাদক গ্রহণের পেছনে অনেক সময় থাকে নিছক কৌতূহল কিংবা ‘নতুন কিছু’ চেষ্টা করার আকাঙ্ক্ষা। অনেক তরুণ মনে করেন একবার চেষ্টা করলে ক্ষতি হবে না। কিন্তু একবারের সেই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে আসক্তির রূপ নেয়। কেউ কেউ আনন্দ বা উত্তেজনা পাওয়ার জন্যও মাদক গ্রহণ শুরু করে থাকে।
৬. প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব
বর্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল বিনোদনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, মিউজিক ভিডিও কিংবা ইনফ্লুয়েন্সারদের কনটেন্টে অনেক সময় মাদককে গ্ল্যামারাইজ করে উপস্থাপন করা হয়, যা কিশোর-তরুণদের মনে আকর্ষণ তৈরি করে। এই ধরনের উপস্থাপনা “স্টাইল” বা “আধুনিকতা”র প্রতীক হিসেবে মাদককে তুলে ধরায় অনেকেই এতে প্রলুব্ধ হয়।
৭. সহজলভ্যতা ও অবৈধ বিক্রির প্রভাব
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে মাদক এখন অনেক সহজলভ্য। ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিল ইত্যাদি বেশ কিছু এলাকায় স্বল্পমূল্যে সহজেই পাওয়া যায়। অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে বা তরুণদের আড্ডাস্থলে এইসব মাদক ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রশাসনের নজরদারিতে দুর্বলতা থাকায় এই প্রবণতা আরও বাড়ছে।
মাদকাসক্তির লক্ষণসমূহ
মাদকাসক্তি একটি ধ্বংসাত্মক প্রবণতা, যা শরীর, মন ও সামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি ধীরে ধীরে ব্যক্তিকে গ্রাস করে, এবং শুরুতে বোঝা না গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একাধিক লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। নিচে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সাধারণ কিছু লক্ষণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
১. বারবার মাদক গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা
মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা নিয়মিতভাবে মাদক গ্রহণ করতে চায়, এমনকি যখন তারা জানে এটি তাদের ক্ষতি করছে তখনও। এ ধরনের তীব্র ইচ্ছাকে “ক্রেভিং” বলা হয়। মাদক না পেলে তারা অস্থির হয়ে পড়ে এবং যেকোনোভাবে তা সংগ্রহ করতে চেষ্টা করে। অনেক সময় এই আকাঙ্ক্ষা এতটাই প্রবল হয় যে, সেটি তাদের নৈতিকতা বা দায়িত্ববোধকে অগ্রাহ্য করে।
২. শারীরিক উপসর্গ ও দুর্বলতা
মাদক গ্রহণের কারণে শরীরে একাধিক শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- মাথা ঘোরা, দুর্বল লাগা
- ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা
- অতিরিক্ত ওজন হ্রাস বা ক্ষুধামান্দ্য
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা স্থির দৃষ্টির অভাব
- দ্রুত হৃদস্পন্দন, ঘাম, হাত কাঁপা ইত্যাদি
এসব উপসর্গ অনেক সময় মাদক গ্রহণের পরপরই অথবা না পাওয়ার সময় দেখা যায়।
৩. আচরণগত পরিবর্তন ও মেজাজের অস্থিরতা
মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণে ধীরে ধীরে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। কিছু লক্ষণ হলো:
- সহজে রেগে যাওয়া বা খিটখিটে মেজাজ
- অকারণে হাসি, কান্না বা আবেগের অতিরিক্ত প্রকাশ
- কথাবার্তায় অসংলগ্নতা বা যুক্তিহীনতা
- নিয়মিত দায়িত্ব পালনে অনীহা বা অমনোযোগিতা
- আত্মবিশ্বাসের অভাব বা হঠাৎ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস
এই আচরণগত পরিবর্তন তার পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে।
৪. পরিবার ও সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে। তারা একাকীত্ব পছন্দ করতে শুরু করে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এড়িয়ে চলে। এ ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করে এবং এক পর্যায়ে বিষণ্ণতা বা আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
৫. অপরাধমূলক বা অনৈতিক আচরণে জড়িয়ে পড়া
মাদক সংগ্রহের জন্য অনেক সময় অর্থের প্রয়োজন হয়। যখন পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পদ শেষ হয়ে যায়, তখন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে:
- চুরি করা (পরিবার বা পরিবারের বাইরে)
- মিথ্যাচার করা বা প্রতারণা করা
- সহিংসতা বা আক্রমণাত্মক আচরণ প্রদর্শন করা
- অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হওয়া
এই ধরণের আচরণ কেবল ব্যক্তিকেই নয়, বরং পরিবার ও সমাজকেও চরম ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।
প্রতিকার ও চিকিৎসা পদ্ধতি
১. মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে মাদকাসক্তি শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা হিসেবেও বিবেচিত। তাই থেরাপির মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব:
- কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): এই থেরাপিতে রোগীর চিন্তাভাবনা ও আচরণগত ধরণ বিশ্লেষণ করে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়। এতে রোগী নিজেই বুঝতে শেখে কীভাবে ট্রিগারিং সিচুয়েশনে নিজের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
- মোটিভেশনাল ইন্টারভিউইং (MI): এটি এমন একটি থেরাপি, যেখানে থেরাপিস্ট রোগীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। মাদক ছাড়তে অনুপ্রেরণা জোগানো হয়, পরিবর্তনের উপকারিতা ব্যাখ্যা করা হয়।
- ডায়ালেকটিকাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT): বিশেষ করে সহ-উপসর্গ যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বা আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা থাকলে এটি ব্যবহৃত হয়।
২. ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা
- ডিটক্সিফিকেশন (Detoxification): প্রথম ধাপে শরীর থেকে বিষাক্ত মাদক অপসারণ করা হয়। এটি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে করানো হয়।
- ওষুধ নির্ভর চিকিৎসা: কিছু ক্ষেত্রে বুপ্রেনোর্ফিন, মেথাডোন, নালট্রেক্সোন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, যা আসক্তি কমাতে সহায়ক।
৩. হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ভূমিকা
হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এই সমস্যার ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ও সার্বজনিন সমাধান। বাংলাদেশে বেশ কিছু মানসিক হাসপাতাল ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে, যেখানে মাদকাসক্ত রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেরাপি, গ্রুপ কাউন্সেলিং, ও মেডিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়।
৪. পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির জন্য পরিবার ও সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সহানুভূতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ রোগীর আত্মবিশ্বাস ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৫. প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ গ্রহন করা
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচি
- তরুণদের জন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি
- পরিবারে সময় দেওয়া ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা
- সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ
আমরা কিভাবে সহায়তা করছি?
এনলাইটেন্ড সাইকিয়াট্রিক হসপিটাল মাদকাসক্ত রোগীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের চিকিৎসা কার্যক্রম শুধুমাত্র ওষুধনির্ভর নয়, বরং ব্যক্তির মানসিক, সামাজিক ও আবেগীয় দিকগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি সমন্বিত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়।
১. পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ও ডায়াগনসিস
প্রথমেই রোগীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে:
- মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন (psychological assessment)
- সহ-উপসর্গ যেমন বিষণ্নতা, উদ্বেগ, PTSD ইত্যাদি যাচাই
- পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
২. ডিটক্সিফিকেশন ও মেডিক্যাল সাপোর্ট
আমাদের হাসপাতালে প্রশিক্ষিত মেডিকেল টিম দ্বারা পর্যবেক্ষণাধীন ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। এতে মাদকের শারীরিক নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমানো হয়, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নালট্রেক্সোন, বুপ্রেনোর্ফিন বা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ দেওয়া হয়।
৩. থেরাপি ও কাউন্সেলিং সেবা
আমাদের সাইকোলজিস্ট ও থেরাপিস্টরা নিয়মিত থেরাপি সেশন পরিচালনা করেন:
- কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): রোগীর চিন্তার ভুল ধরণ শনাক্ত ও তা সংশোধন।
- মোটিভেশনাল ইন্টারভিউইং (MI): রোগীকে স্বপ্রণোদিত করে মাদক ছাড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা।
- গ্রুপ থেরাপি ও পারিবারিক কাউন্সেলিং: সামাজিক সহায়তা ও পারিবারিক জড়িততা তৈরি।
- রিল্যাপস/স্লিপ প্রিভেনশন প্ল্যান: ভবিষ্যতে আবার মাদক গ্রহণের ঝুঁকি কমাতে কৌশল শেখানো হয়।
৪. পুনর্বাসন ও ফলো-আপ ব্যবস্থা
রোগীকে পুনরায় সমাজে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের রয়েছে একটি সুসংগঠিত রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরেও আমরা ফলো-আপ থেরাপি, টেলিফোন কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনে পুনরায় ভর্তি গ্রহণের সুযোগ দিয়ে থাকি।
৫. গোপনীয়তা ও সম্মানের পরিবেশ
রোগীর গোপনীয়তা আমাদের জন্য অগ্রাধিকার। আমরা একটি নির্ভরযোগ্য, সহানুভূতিশীল ও অপবাদের-রহিত চিকিৎসা পরিবেশ নিশ্চিত করি, যাতে রোগীরা সম্মানের সঙ্গে চিকিৎসা নিতে পারেন।
মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে প্রতিরোধের মতো প্রতিকারও জরুরি
মাদকাসক্তি একটি ভয়াবহ এবং জটিল সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ক্ষেত্রভিত্তিক কাজের আলোকে বলা যায়, বর্তমানে প্রতিরোধের মতো প্রতিকারের দিকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
১. প্রতিরোধ কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা
সচেতনতা কর্মসূচি, স্কুলে বক্তব্য, পোস্টার, সামাজিক প্রচার ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক কৌশল নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে কার্যকর হলেও, এটি কেবলমাত্র সেই শ্রেণিকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পারে যারা এখনও মাদক গ্রহণ শুরু করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের শহর, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ তরুণ ইতিমধ্যেই কোনো না কোনো পর্যায়ে মাদক গ্রহণ করে ফেলেছে। এই অবস্থায় প্রতিরোধ নয়, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
২. আসক্তির পিছনে গভীর মানসিক কারণ
অনেক ক্ষেত্রে মাদক গ্রহণ কেবল “জানার অভাব” বা “বন্ধুদের প্ররোচনা” থেকে নয়, বরং মানসিক আঘাত, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অবসাদ, পারিবারিক অবহেলা, ইত্যাদি গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ থেকে আসে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক বার্তা কার্যকর হয় না। বরং প্রয়োজন হয় পেশাদার চিকিৎসা, থেরাপি এবং মনোবিশ্লেষণ—যা কেবল প্রতিকার পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব।
৩. রোগীকে বাঁচানোই এখন অগ্রাধিকার
যখন একজন ব্যক্তি ইতোমধ্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, তখন সামাজিক প্রচারণা বা ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হয় না। বরং তাকে পেশাদার সহায়তার আওতায় এনে চিকিৎসা, থেরাপি, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে তার জীবন রক্ষা করাই মুখ্য। ঠিক এই কারণে প্রতিকার এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে উঠেছে।
৪. প্রতিকার ব্যবস্থা না থাকলে প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়
একটি সমাজে যদি মাদকাসক্ত রোগীদের জন্য সুষ্ঠু চিকিৎসা, মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপি ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে এমন মানুষরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং বারবার relapse বা পুনরায় মাদক গ্রহণে ফিরে যান। এতে সামাজিকভাবে অন্যদের মাঝেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, এবং প্রতিরোধমূলক প্রচেষ্টাও অর্থহীন হয়ে যায়। প্রতিকার কাঠামো না থাকলে, প্রতিরোধ একমাত্র কৌশল হিসেবে সফল হতে পারে না।
৫. উন্নত দেশগুলোর মডেলেও প্রতিকারে জোর
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া—এরা মাদকবিরোধী যুদ্ধে প্রতিকারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সেখানে মাদকাসক্তি এখন একটি ‘disease’ বা রোগ হিসেবে স্বীকৃত, এবং এর জন্য মেডিকেল থেরাপি, বিহেভিয়োরাল ট্রিটমেন্ট ও ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি
উপসংহার
মাদকাসক্তি যতই ভয়ংকর হোক না কেন এর প্রতিকার সম্ভব —যদি থাকে সচেতনতা, সহানুভূতি এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির সহায়তা। একজন মানুষ আসক্তির যতোটা গভীরে নিমজ্জিত হোক না কেন, চিকিৎসা ও ভালোবাসার স্পর্শে সে আবার ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। আমরা যদি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ একত্রে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসি, তবে এই ব্যাধি রোধ করা সম্ভব।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন সাইকোথেরাপি, কাউন্সেলিং, ইনপেশেন্ট রিহ্যাব সেবা আমাদের সামনে নতুন আশার দরজা খুলে দিয়েছে। আজ যারা অন্ধকারে, কাল তারা আলোয় ফিরতে পারে—শুধু প্রয়োজন সচেতন প্রয়াস ও মানসিক সহায়তার।
চলুন, আমরা একসাথে একটি মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই, আশার আলো জ্বালিয়ে দিই—কারণ প্রত্যেক জীবনই মূল্যবান, আর পরিবর্তন সবসময় সম্ভব।